রাশিয়াতে আমার আঠারো দিন

দিনটা শুরু হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সকাল থেকে; কারণ পরদিন সকাল আমার ফ্লাইট। সাথে কি নিবো না নিবো তা নিয়ে ছিল দ্বিধা দ্বন্দ্ব। পাশাপাশি এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাও আবার যাওয়া আসা মিলে ২০ দিনের একটা লম্বা ভ্রমণ, যার পুরো খরচ রাশিয়ার সরকার বহন করবে।সদ্য অনার্স শেষ করলাম; মনে হচ্ছিল হাফ ছেড়ে আমি এখন নিঃশ্বাস নিবো। আমি তখন ২৪ এ পা রাখবো আর এক সপ্তাহ বাকি।

চলুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে আমি এই সুযোগটি পেয়েছি এবং এটা কিসের। আগস্ট মাসে আমার অনার্স চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে World Youth Festival 2024 এর একটি খবর চোখে পরে, যেটা রাশিয়ার সোচি শহরে হবে। উক্ত ইভেন্টে অনলাইনে আবেদন করি। বেশ কয়েকটি ধাপে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যেখানে বিভিন্ন বিভাগ (যেমন: নেতৃত্বে, আইটি, ভলেন্টিয়ার, গবেষক, সামাজিক প্রকল্প, শিক্ষক, সাহিত্য, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, পাবলিক স্পিকিং, মিডিয়া, নাচ, গান, ও খেলাধুলা ইত্যাদি।) যুবক ও যুবতীরা অংশ নিবে। সারা বিশ্ব থেকে আরো ২০ হাজার ডেলিগেটস অংশ নিবে। ১০ হাজার রাশিয়া থেকে আর বাকি ১০ হাজার অন্যান্য সকল দেশ থেকে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল ভেদাভেদ নির্বিশেষে আন্তর্জাতিক যুব সহযোগীতা বিকাশ ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগামী বিশ্ব প্রজন্মের ভূমিকা বাড়ানো। আইটি বিভাগ থেকে নির্বাচিত হই আমিও বিশ হাজার এর মধ্যে।

আরেকটা দারুন বিষয় হচ্ছে পহেলা মার্চ থেকে সাতই মার্চ মূল প্রোগ্রাম। যেখানে সবাই থাকবে। তারপর বিশ হাজার এর মধ্যে থেকে আঠারো হাজার অংশগ্রহণকারী চলে যাবেন নিজ দেশে। আর বাকি দুই হাজার অংশগ্রহণকারী সুযোগ পাবে আরো এগারো দিন থাকার এবং রাশিয়ার ত্রিশটি রিজিওন ঘুরে দেখার। সৌভাগ্যক্রমে আমিও একজন ছিলাম এবং নির্বাচিত হয়েছিলাম চেলিয়াবিনস্ক রিজিওন এর জন্য বাকি ১১ দিন ঘুরার।

১৯ ফেব্রুয়ারি ভিসার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করি(দশ মিনিটের ও কম সময়ে), এর পরেরদিন রাশিয়ান এম্ব্যাসিতে পাসপোর্ট জমা দেই ইনভাইটেশন লেটার সহ। ২১ তারিখ সকালে ভিসা নিয়ে আসি। জীবনের প্রথম পাসপোর্টে ভিসা লাগাই; মুহূর্তটা ছিল খুবই অসাধারণ ও আবেগের।

বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৯৫ জন ডেলিগেটস যাচ্ছে উক্ত ইভেন্টে; কিন্তু সবাই একসাথে যাচ্ছে না, কারণ আমরা ৪৫ জন এর মতো ফুল ফান্ড, আর বাকিরা নিজেদের খরচে টিকেট কেটে ভিন্ন ফ্লাইটে যেভাবে খুশি সেভাবে যাচ্ছে। তাও আমরা ৪৫ জন এর ফ্লাইট ও ৪ সময়ে হয়। কারো ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখে ফ্লাইট।

যাইহোক, সবই রেডি; কিন্তু আমি এতো টা উত্তেজিত না; যে আমি রাশিয়া যাচ্ছি। সন্ধ্যায় চলে গেলাম উত্তরা, ঢাকা অন্য ডেলিগেটসদের সাথে যোগ দিতে। এ যাত্রায় আমরা ১০ জন একসাথে যাচ্ছিলাম তুর্কি এয়ারলাইনস দিয়ে। কেউ আইটি , সিকিউরিটি, প্রফেসর, ডাক্তার, ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট, ব্যবসায়ী, ও উদ্যোক্তা। আমরা পরিচয় পর্ব শেষ করতে না করতেই সময় হয়ে গেলো। বের হলাম এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে। চেকিং ও ইমিগ্রেশন শেষ হলো, বিমানে উঠবো এখন। তাও কেমন জানি একটুও উত্তেজনা নেই মনে। ভাবতেছিলাম রাশিয়া কি আমি আদৌ যাচ্ছি? বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিমানে উঠলাম আর ভাবলাম বিমান ছাড়লে মনে হয় বলতে পারবো আমি রাশিয়া যাচ্ছি; নয়তো না।

যখন রানওয়েতে বিমান উড্ডয়নের জন্য রেডি ও ভূমি থেকে এক ফুট, দুই ফুট এমন উচ্চতায় উঠছে, এইযে সময়টা; ওই সময়টায় আমার মনে যে আনন্দের অনুভূতি হয়েছিল সেটা লেখার আর ভাষা নেই। মনে হচ্ছিল সারাজীবনের উত্তেজনা ও ভালো লাগা ঠিক তখনই লেগেছিল।

তুর্কি এয়ারপোর্টে আমাদের ৮ ঘণ্টার layover শেষে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা দেই অন্য ফ্লাইটে। যাত্রাকালীন আমার সাথে বসা মধ্যবয়স্ক একজন রাশিয়ান মহিলার সাথে পরিচয়। উনি ক্যালিফর্নিয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন গণিতের প্রফেসর। পুরো যাত্রায় দুজনের মধ্যে বেশ গল্প হয়ে গেল। সুস্থভাবে পৌছালাম মস্কো এয়ারপোর্টে।

অনেক অনেক ক্লান্ত হয়ে পরি, কিছুটা ঠান্ডা অনুভূত হয়। ভিতরে হিটার এর ব্যবস্থা থাকায় বাহিরের বৈরী আবহাওয়ার ঠের পেলাম না। তাপমাত্রা তখন মাইনাস ডিগ্রি। ইমিগ্রেশন শেষ করে সবাই একসাথে হলাম, দেখা হলো অন্য দেশের কিছু ডেলিগেটসদের সাথে। তাদের সাথে গল্প, হাসি, আর মস্কো শহরে একটু উঁকি মারা হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম এটা বরফের দেশ।

সময় হয়ে গেলো পরবর্তী ফ্লাইটের। মস্কো থেকে রাশিয়ার অলিম্পিক শহর সুচিতে। সূচি এয়ারপোর্টে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায় নেচে গেয়ে কিছু সুন্দর তরুণ-তরুণী। সেখান থেকে বাসযোগে আমাদের হোটেলে নেয়া হলো। দেখা হলো কতো সুন্দর পরিবেশ চারদিকের। মনে হচ্ছিল আমি জাদুর শহরে ঘুরছি। সারা পৃথিবীর বিশ হাজার যুবক এই শহরটায় আস্তে আস্তে আসছিল নিজ মাতৃভূমি থেকে। হোটেলে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম অসংখ্য যুবক যুবতীদের। খুবই আনন্দ পাই পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশের উজ্জ্বল চেহারাগুলো দেখে। মনে হচ্ছিল এ শহরটা একটা বাগানে রূপান্তরিত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, ও জাতি নির্বিশেষে সকলকে একসাথে দেখে মনে হলো পৃথিবীর মানুষগুলো আসলেই কতো সুন্দর!

হোটেল চেকিং শেষে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেলো। অন্যান্য বাংলাদেশী ডেলিগেটসদের সাথে দেখা হলো। অনেক ভালো লাগলো। শরীর অনেক ক্লান্ত ; তাও মনে অনেক আনন্দ। কালো সাগর থেকে মিষ্টি বাতাস ভেসে আসছিল। চারদিক ছিল সবুজ, কিছুটা রোদ্দুর ভাব; এর মধ্যেই হারিয়ে গেলাম আমি। অনেক কাজ বাকি, বাসযোগে গেলাম এয়ারপোর্টে প্রয়োজনীয় কিটস(সৌভেনুর, সিম কার্ড ও ব্যাংক কার্ড) সংগ্রহ করতে। অনেক সময় চলে গেলো এতো মানুষের লম্বা সিরিয়ালে। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। সবাই সবার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে সবকিছু সম্পন্ন করে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন থেকে অফিসিয়াল প্রোগ্রাম শুরু হবে ওপেনিং ceremony এর মধ্য দিয়ে, তাই দ্রুতই একটা ভালো ঘুম দিয়ে ফেললাম হোটেলে এসে।

প্রথম মার্চ থেকে সাত মার্চ প্রধান প্রোগ্রাম রাশিয়ার অলিম্পিক শহর সুচিতে। যেখানে বিশ হাজার যুবক-যুবতী এসেছে বিশ্বের ১৯০ টি দেশ থেকে। এখন এই সাত দিনের অভিজ্ঞতা যদি লিখি তাহলে মোটামুটি ছোট একটা বই লেখা যাবে। কিন্তু আমি আজকে আমার শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরবো ছোট করে গল্পের মধ্যেই। যেগুলো আপনাদের কাছে অনেক ছোট মনে হতে পারে।

পুরো সুচি শহর জুড়ে এক থেকে দুই কিলোমিটার ব্যবধানে অসংখ্য ভেন্যু ও শত শত ইভেন্ট হয় সপ্তাহব্যাপী। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, টকশো, পাবলিক স্পিকিং, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, ইত্যাদি সেমিনার হয়। যেগুলো এক থেকে দেড় ঘণ্টাব্যাপী হয়ে থাকে। সবাই যার যার আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। কোথাও কোনো হুইহুল্লুর নেই। সকল ইভেন্ট শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ হয় এবং সৌভিনিউর, পুরস্কার সাথে সাথেই দিয়ে দেয়া হয়। সকল প্রোগ্রাম সময়মত শুরু ও শেষ হয়।

আমাদের কে সুন্দর একটি অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্য ৫০০০ ভলান্টিয়ার এর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসার দাবিদার। আমি দেখেছি প্রত্যেকটা ভলান্টিয়ার তার নিজের কাজ খুব যত্নসহকারে করছে। কোথায় যেনো পড়েছিলাম রাশিয়ার মানুষদের মুখে হাসি নেই। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো প্রমাণ হলো। তাদের এতো সুন্দর আপ্যায়ন সারাজীবন স্মৃতিতে থাকবে। যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছি, মুহূর্তের মধ্যে এর সমাধান হয়েছে।

সাতদিন কেটে গেলো খুবই দ্রুত। যতটুকু পেরেছি সারাদিনই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি বিভিন্ন সেমিনার, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ও চেষ্টা করেছি নতুন কিছু নেয়ার জন্য। এই সাতদিনের খাবারের অভিজ্ঞতা যদি বর্ণনা করি তা ছিল অতুলনীয়। অবশ্যই সকল খাবার ছিল ফ্রেশ; এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে খাবার পরিবেশনে সুন্দর শৃঙ্খলা। আমি শিখেছি সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ ও মূল্যবোধ।

প্রথম চার দিন বিভিন্ন সেমিনার, খেলাধুলা ও অনুষ্ঠান উপভোগ করেই কেটে গেলো। তৃতীয় দিনে পুশআপ কম্পিটিশন ও অন্যান্য শারীরিক ব্যায়াম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে খুবই ক্লান্ত হয়ে পরি। ওহ্! ৩৭ টা পুশআপ দিয়ে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলাম। একইসাথে বাংলাদেশ ও তাজিকিস্তান এর ফ্রেন্ডলি ফুটবল খেলায় আমি ১ টি গোল করি।

স্পেশাল একটা দিনের বর্ণনা না করলেই নয়। ৫ই মার্চ ছিল আমার জন্মদিন। আমি জানতাম না আমাকে নিয়ে একটা বন্ধু দেশের ডেলিগেট্স প্ল্যান করে রেখেছে আমাকে জম্মদিনের দারুন একটা মূহুর্ত দেয়ার জন্য। ওরেনবার্গ রাশিয়ার একটি শহর; যেখান থেকে ৫০ এর উপড় ডেলিগেইটস এসেছে WYF2024 এ। সূচি শহরের স্টেডিয়াম এর সামনে হাজারো ডেলিগেটস এর উপস্থিতিতে আমাকে তাদের দল নিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী নেচে গেয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। সেখানে আমার বাংলাদেশী ডেলিগেট্স ভাই ও বোন অংশগ্রহণ করে। দিনটি ছিল জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের। বাংলাদেশ থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও লিও ক্লাব অব ঢাকা আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। এতো ভালোবাসা পেয়ে আমার দিনটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আর আমি প্রথমদিন থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম যে এবার আমার জন্মদিন পালন করবো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। যেমন: আমার টার্গেট ছিল ১০০ দেশের ১০০ ডেলিগেটস এর সাথে পরিচয় হবো, আমার বাংলা ভাষার ইতিহাসের কথা বলবো ও একটা করে সেলফি তুলবো। এবং সেগুলো দিয়ে আমার জন্মদিনে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গুলোতে শেয়ার করবো। ১০০ টার্গেট পূরণ করতে না পারলেও আমি ৬৫ দেশের ৬৫ জন ডেলিগেটস দের সাথে আমার মিশন টি বাস্তবায়িত করতে পেরেছি।

চলুন ষষ্ঠ দিনের কথা জেনে নেয়া যাক। সূচি অলিম্পিক শহরটি কালো সাগর ঘেঁষেই অবস্থিত। আমার হোটেল থেকে ১২ থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটার দুরত্ব। ভাবলাম এটা নিজ চোখে দেখার আনন্দ মিস করা যাবে না। ম্যাপ ধরে চলে গেলাম কালো সাগরের পাড়ে। দেখে আনন্দের সাধ মিঠছে না, পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে খুব। কি আর করা, ভাবলাম পানিতে একটু হাতটা ভিজিয়ে ফেলি। তাহলে দেশে গিয়ে গর্বের সহিত বলতে পারবো আমি কালো সাগর থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসেছি। স্রোতের মৃদু গর্জন, বড় বড় ডলফিন এতো কাছে এসে ভাসছে তা দেখে আমি খুবই আনন্দিত হচ্ছিলাম। মুহূর্তগুলো ধারণ করে পরিচিতদের সাথে ভাগাভাগী করছিলাম। একজন মধ্যবয়স্ক সূচি অঞ্চলের বাসিন্দা আমার সাথে কিছুক্ষন সঙ্গ দেয়। তীর ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে আরো দুইজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দেখতে পাই, আমাকে দেখে একজন হাসতে হাসতে দৌড়ে আসে আর বলে তোমাকে একটা কিস করতে চাই। আমি অনুমতি দেই এবং উনি আমাকে উনার ছেলের মতো করে আমাকে চুমু খায় আর একটা সেলফিও তুলে নেয়। আড়াই তিন কিঃমিঃ হেঁটে চলে যাই স্টেডিয়াম এর কাছে; যেখানে WYF এর বিভিন্ন ইভেন্ট হচ্ছে। এই দিন বিকেলটা বিভিন্ন সেমিনার ও সেশন এ কাটিয়ে দেই।

সপ্তম দিনের কথা না বললে মনে হয় অনেক কিছু বাকি রয়ে যাবে। গত ৫ টা দিন দ্রুত চলে যাওয়ায় ভাবতেছিলাম এই সূচি শহরের বাইরে কোথাও ঘুরে আসি; নয়তো অপূর্ণতা থেকে যাবে। কথা হচ্ছে সকল ডেলিগেটস দের জন্য ফ্রি শাটল বাস থাকায় আমার ভাবনাটা সহজেই বাস্তবে রূপদান করে ফেলি। বাংলাদেশী ৬ জন ডেলিগেটস ভাইদের নিয়ে চলে যাই নিকটস্থ খুবই পরিচিত একটি বরফের পাহাড়ে। পাহাড়ের নাম Roza Khutor, অলিম্পিক গ্রাম নামে একটি স্পট আছে সেখানে। বাসযোগে যাওয়ার সময় চমৎকার নৈশ্বর্গিক সৌন্দর্য দেখার আনন্দ এখনো চোখে ভাসছে। ভুলতে পারছিনা, কেনো জানি মন চাচ্ছে তাঁকিয়ে থাকতে সেই উচু উচু মেঘ ছোঁয়া বরফের পাহাড়গুলোর দিকে। মাঝে মাঝে পাহাড় ঘেঁষে, পাহাড়ের বুকের ভেতরে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাস চালক। খালি চোখে দেখবো না ক্যামেরাবন্দি করবো, না বাড়িতে ফোন দিয়ে সবাইকে দেখাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যাইহোক সবই হয়ে গেলো। বাংলাদেশ থেকে আব্বা, আম্মা, বোন, ভাই, আদরের ভাগ্নী ও ভাইগ্না, সুদূর লিবিয়া থেকে বোন জামাই এবং আমেরিকা থেকে আমার শিক্ষক সের্গেই কষ্টিন সবাইকে ভিডিওকলে আমার আনন্দটা ভাগাভাগি করে ফেলি। আর আমার শ্রদ্ধেয় স্যার লায়ন ড. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দীন(যিনি বর্তমান বাংলাদেশ লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এ১ এর গভর্ণর) বলেছিলেন, “জুবায়ের তোমার রাশিয়া অভিজ্ঞতা ও মুহূর্তগুলো আমাকে ভিডিও করে পাঠাবে।” তো উনাকেও আমার আনন্দের মুহূর্তগুলো ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলে পাঠিয়ে ভাগ করে নেই।

আরেকটা দারুন ঘটনা ঘটে গেলো! তাহলে বলা যাক।আমরা বাংলাদেশী বলে কথা! দরাদরি না করলে মনে হয় ঠকে গেলাম। ক্যাবল কার দিয়ে পাহাড়ের উঁচুতে উঠতে হয় মেঘের আসল সৌন্দর্য দেখতে। Roza Khator পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে যাওয়ার প্ল্যান করি আমরা। কিন্তু এই সেবা প্রদানকারী টিকেট কাউন্টারগুলো ৩ হাজার করে চাচ্ছে। তখন আমরা ভাবতেছিলাম কিভাবে খরচ টা একটু কমানো যায়। কোনো এক ভাই বলে উঠলো ব্ল্যাক এ টিকেট পাওয়া যেতে পারে। আমি ভাবলাম এটা তো বাংলাদেশ রেলওয়ে তে সম্ভব জানি! ভাগ্যিস, পেয়ে গেলাম একজন প্রফেশনাল Ice Sportsman। সে নাকি ব্ল্যাক এ টিকেট বিক্রি করে এবং ৬০০ টাকা করে কম রাখবে। ভালো কথা, কনফার্ম করে ফেললাম সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে। আমাদেরকে নিয়ে যাবে একদম তৃতীয় টার্মিনালে, সেটাই হচ্ছে Roza Khator এর সর্বোচ্চ পর্যায়। প্রতিটা ধাপেই আমরা নেমে চারপাশ দেখে, ছবি তুলে দেখে দেখে উপরে চলে গেলাম। ততক্ষণে বিকেল ঘনিয়ে আসছে। ঘন মেঘ, তুষারপাত আর কনকনে ঠান্ডায় ভীত হয়ে যাচ্ছিলাম। আর ক্যাবল কার এ জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা নিচ্ছিলাম। খুবই দারুণ লেগেছে। উপরে উঠে আমরা সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি, বরফে চলে এমন সকল জুতো, গাড়ি আরো কি জানি সবকিছু পড়ে ট্রায়াল দেয়া হয়ে গেলো। অনেক স্পোর্টসম্যান এই উচ্চতায় থেকে একদম নিচে নামে ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে বিশেষ একধরনের জুতো পরিধান করে। আমাদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হোটেলে এসে সবকিছু ঘুচানো হয়ে গেলো; কারণ মধ্যরাতেই এডলার রেলওয়েস্টেশন এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। সারারাত সজাগ ছিলাম। আর স্মৃতিচারণ করছিলাম মুহূর্তগুলো। এখান থেকেই ১৮ হাজার ডেলিগেটস চলে যাচ্ছে নিজ দেশে। আর আমাকে আরো ১১ দিন থাকতে হবে। সবার মুখে মায়াকান্না। কারণ এই সাতদিনে আমরা একটা বিশাল পরিবার গঠন করে ফেলেছিলাম।

অষ্টম দিনে ভোর ৪ টায় আমরা ট্রেনে করে সূচি থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। মস্কো পোঁছাতে আমাদের ৩৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এই অভিজ্ঞতা আরো চমৎকার। আমাদের কে মেটালফ্রেম সহ একটি কাঁচের গ্লাস উপহার হিসেবে দেয়া হয় ট্রেন কর্তৃপক্ষ থেকে। দৈব চয়নের মাধ্যমে একেক কামড়ায় একেক দেশের একজন করে ডেলিগেটস সিট পাই। প্রতি কামড়ায় ৪ জন করে ছিলাম। আমাদের কামরায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া এবং মস্কো এই ৪ দেশের ৪ জন ছিলাম। কামরা ছিলো বেশ বড়। আমাদের কে সর্বোচ্চ সেবা দেয় ট্রেন কর্মচারিরা। যাত্রাপথে কতো সুন্দর বরফে আবৃত মনোরম গ্রাম, শহর ও প্রাকৃতিক দৃশ্য এর চিত্র দেখতে পাই। দীর্ঘ এই ভ্রমণে অনেক নতুন ডেলিগেটস এর সাথে পরিচয় হয়, বেশ কয়েকটি বড় শহর হয়ে আমাদের ট্রেন মস্কোতে পৌঁছে। সবমিলিয়ে ট্রেন যাত্রাটি খুবই আনন্দের ছিল।

মস্কোতে আমরা দুদিন হোটেলে থাকি ও শহরের গুরত্বপূর্ণ স্থাপনা, জাদুঘর ও মেট্রো দেখা হয় অভিজ্ঞ গাইড এর সহযোগিতায়। এর মধ্যে রেড স্কয়ার অন্যতম। আসলে এটি এক জাদুর শহর। নিজ চোখে না দেখলে, হাজার বই পড়েও আনন্দের অনুভূতি নেয়া যাবে না। ১০০ বছর পুরোনো রাজকীয় বিল্ডিংগুলো এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৩৫ সালে তৈরি করা মাটির নিচে মেট্রো! এ যেনো আরেকটা শহর। মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারেন। মাটির নিচেই ৪৫০ কিঃমিঃ মেট্রো এর লাইন। আর এর নান্দনিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য আপনার নজর কাড়বে।

দ্বিতীয়দিন রাতেই আমরা চলে যাই চেল্যবিনস্ক রাজ্যে। শহরের রেডিসন ব্লু হোটেলে চেকইন করি। ঠান্ডার কিছু কিটস দেয়া হয় আমাদেরকে। সেখানকার ভলান্টিয়ার ও মস্কো থেকে আগত ভলান্টিয়ার নিরলস পরিশ্রম করে আমাদের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সহযোগীতা করে। ৪ দিনের শিডিউল করা হয় চেলিয়বিনস্ক শহর ঘুরার। যেখানে আমাদের বড় বড় শিল্পকারখানা, যাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, খাবার উৎপাদনের ফ্যাক্টরি, দৃষ্টিনন্দন জায়গা, বরফের উঁচু পাহাড়, স্থানীয় কুইসিন, স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাবার, কনসার্ট ও স্থানীয় গভর্ণর এর সাথে সাক্ষাৎকার ইত্যাদি অভিজ্ঞতা অর্জন করি। প্রতিটা দিনই ছিলো চমৎকার কিছু মূহুর্ত।

আসলে প্রতিটা মূহুর্ত নিজের খালি চোখে দেখার আনন্দ কখনই আমি লিখে ও বলে বোঝাতে পারবো না। সত্যি পৃথিবীটা কতোই না সুন্দর। এই ৫ দিনের অভিজ্ঞতাও যদি লিখি অনেক বড় লিখা হয়ে যাবে। যদিও লিখি কোনো একদিন একটি ছোট বইয়ে স্থান পাবে মুহূর্তগুলোর বর্ণনা।

ভালবাসা আমার পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি, প্রিয় বন্ধু রিক্তামণি যে আমাকে অনেক সহযোগীতা করেছে রাশিয়া যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহুর্তে। শ্রদ্ধেয় বড় দুই ভাই, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রিপারেটরী কমিটির চেয়ারম্যান ; ফারহান তারেকজিয়া উদ্দীন হায়দার। ফারহান ভাই কল দিয়ে বলছিলেন, “জুবায়ের তোমার টিকেট কাটা হয়েছে, ওয়েবসাইটে চেক করো”। মুহুর্তটা ভুলবার নয়, খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম।

আর শ্রদ্ধেয় স্যার লায়ন ড. মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এমজেএফ (ডিস্ট্রিক্ট গভর্ণর ৩১৫এ১, বাংলাদেশ); যার কাছে নেতৃত্ব চর্চা শিখি, যিনি আমার রাশিয়ার অভিজ্ঞতাকে আরো প্রাণজ্জ্বলভাবে উপভোগ করতে সহায়তা করেছেন, পরিবারের একজন সদস্যের মতো আমার খবর নিয়েছেন।

আমার শিক্ষক, অণুপ্রেরণা সার্জেই কস্টিন উনাকে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ব্যক্তিজীবনে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে সুপরামর্শ, সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে গেছেন। রাশিয়া আমার যাওয়া হতো না, যদিনা উনি আমাকে উৎসাহ না দিতেন।

Scroll to Top